জানাযার আগে নিম্নস্বরে বা উচ্চস্বরে কলেমা তৈয়্যবা, তাসবীহ-তাহলীল বা দরূদ শরীফ অথবা না’ত শরীফ পাঠ করা জায়েয এবং মইয়ত ও সমবেত ব্যক্তিদের জন্য কল্যাণকর। কুরআনী আয়াত, সহীহ, হাদীছ এবং ফকীহগণের বিভিন্ন উক্তিতে এর প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান-
اَلَّذِيْنَ يَذْكُرَوْنَ اللهَ قِيَامًا وَّقُعُوْدًا وَّعَلى جُنُوْبِهِمْ
(যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফ্সীরে রূহুল বয়ানে বর্ণিত আছে-
اَىْ يَذْكُرُوْنَهُ دَائِمًا عَلى الْحَالَاتِ كُلِّهَا قَائِمِيْنَ وَقَائِدِيْنَ وَمُضْطَجِعِيْنَ فَاِنَّ الْاِنْسَانَ لَايَخْلُوْا عَنْ هذِهِ الْهَيْئَاتِ غَالبًا
এ আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে যে কোন অবস্থায় দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে সব সময় আল্লাহর যিকর করা। কেননা মানুষ অধিকাংশ সময় এ তিন অবস্থা থেকে মুক্ত থাকে না।
তাফ্সীরে আবুস সউদে এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে বর্ণিত আছে-
وَالْمُرَادُ تَعْمِيْمُ الذِّكْرِ لِلْاَوْقَاتِ وَتَحْصِيْصُ الْاَحْوَالِ الْمَذْكُوْرَةِ لَيْسَ لِتَخْصِيْصِ الذِّكْرِ بِهَا بَلْ لِاَنَّهَا الْاَحْوَالُ الْمَعْهُوْدَةَ الَّتِىْ لَايَخْلُوْا عَنْهَا الْاِنْسَانُ
(এর অর্থ প্রায় উপরোক্ত তাফ্সীরের মত) তাফ্সীরে কবীরে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছে- (এর অর্থ উপরোক্ত তাফ্সীরের মত) আল্লামা ইবনে আদী ‘কামেল’ গ্রন্থে এবং ইমাম যায়লয়ী (রাঃ)- نصت الراية لتخريج احاديث الهداية নামক কিতাবের ২৯২ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন-
عَنْ اِبْنِ عُمَرَ قَالَ لَمْ يَكُنْ يَسْمَعُ مِنْ رَّسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَمْشِىْ خَلْفَ الْجَنَازَةِ اِلَّا قَوْلَ لَااِلهَ اِلَّا اللهُ مبْدِيا ورَاجِعًا
এ হাদীছটা জয়ীফ হলেও ফজায়েলে আমালের ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। মিসরী ছাপা তাহযিরুল মুখতার আলা রদ্দুল মুখতার কিতাবের ১২৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছে-
উপরোক্ত আয়াত এবং এর তাফ্সীর সমূহ ও হাদীছ সমূহ থেকে দু’টি বিষয় জানা গেল- সর্বাবস্থায় যিকরে ইলাহীর অনুমতি রয়েছে এবং উচ্চস্বরে বা নিম্নস্বরে যে কোনভাবে জায়েয। এখন কোন উপলক্ষে যিকর নিষেধ করার জন্য অন্ততঃ পক্ষে প্রসিদ্ধ হাদীছের প্রয়োজন। কেননা একক হাদীছ বা মুজতাহিদের অনুমান দ্বারা কুরআনের অনির্দিষ্ট হুকুমের নির্দিষ্ট করা যায় না। ফকীহগণ জনাবত ও ঋতুস্রাবের সময়ও কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া সমস্ত যিকর জায়েয বলেছেন এবং কুরআনের আয়াত যদি তেলাওয়াতের নিয়ত ছাড়া পাঠ করা হয়, তাও জায়েয (ফিকহ শাস্ত্রের প্রায় তিকাব দ্রষ্টব্য) তাহলে মইয়তকে কবরস্থানে নিয়ে যাবার সময়টা একটি অবস্থা বিধায়, তখনও সব রকম যিকর জায়েয। কুরআন ইরশাদ ফরমান- اَلَا بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنَّ الْقُلُوْبُ (জেনে রেখ, আল্লাহর স্মরণে চিত্ত প্রশান্ত হয়।) এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রূহুল বয়ানের রচয়িতা বলেন-
মুসলমানগণ কুরআন পাঠ এবং যিকরে ইলাহী (ইসমে আযম) দ্বারা তৃপ্তি লাভ করে এবং শুনতে পছন্দ করে। আর কাপিরগণ দুনিয়াদারীতে তৃপ্ত এবং গায়রুল্লাহর প্রশংসায় আনন্দ লাভ করে।
এ আয়াত ও তাফ্সীরের ভাষ্য থেকে বোঝা গেল- আল্লাহর যিকর মুসলমানের জন্য আনন্দ ও তৃপ্তিদায়ক কিন্তু কাফিরদের জন্য বেদনাদায়ক। খোদার শুকর, মইয়তও মুসলমান এবং সমস্ত শবযাত্রীরাও মুসলমান। সবাই এতে তৃপ্তি পাবে। অধিকন্তু ওই সময় আত্মীয় স্বজন থেকে চির বিদায়ের কারণে মইয়তের মন ভারাক্রান্ত থাকে। তখন এ ধরনের যিকরের দ্বারা পেরেশানী দূরীভূত হয়। লক্ষণীয় যে এ আয়াতে মতলক যিকরের কথা বর্ণিত হয়েছে- উচ্চস্বরে হোক বা নিম্নস্বরে হোক। সুতরাং প্রত্যেক রকম যিকর জায়েয প্রমাণিত হলো। কেবল নিজস্ব রায় দ্বারা এতে শর্তারোপ করা যাবে না।
منتخب كنز العمال কিতাবের ষষ্ঠ খন্ডের ৯৯ পৃষ্ঠায় আনস (রাঃ) এর বরাত দিয়ে বর্ণিত আছে-
اَكْثِرُوْا فِى الْجَنَازَةِ قَوْلَ لَا اِلهَ اِلَّا اللهُ
(জানাযায় বেশী করে কলেমা তৈয়্যবা পড়ুন) মিশকাত শরীফের কিতাবুল দাওয়াতে যিকরুল্লাহ’ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
اِنَّ اللهِ مَلَئِكَةَ يَطُوْفُوْنَ ِفِى الطُّرُقِ يَلْتَمِسُوْنَ اَهْلَ الذِّكْرِ فَاِذَا وَجَدُوْا قَوْمًا يَذْكُرُوْنَ اللهَ تَنَادُوْا هَلُمُّوْا اِلَى حَاجَتِكُمْ قَالَ فَيُحِفُّوْلَهُمْ بِاَجْنِهْتِهِمْ
(আল্লাহর কিছু ফিরিশ্তা রাস্তায় টহল দেয় এবং আল্লাহর যিকরকারীদেরকে অনুসন্ধান করে। যখন কোন জনগোষ্ঠিকে যিকর করতে দেখে, তখন একে অপরকে ডাকাডাকি করে বলে- নিজেদের উদ্দেশ্যের প্রতি আগোয়ান হও। অতঃপর ওই সব যিকরকারীদেরকে পালক দ্বারা আচ্ছাদিত করে নেয়।) সুতরাং মইয়তের লোকেরা যদি আল্লাহর যিকর করতে করতে যায়, তাহলে টহলরত ফিরিশ্তাদের সাক্ষাত মিলবে। তখন সবাইকে পালক দ্বারা আচ্ছাদিত করে নিবে। মইয়তও ফিরিশ্তাদের পালকের ছায়ায় কবরস্থানে পৌঁছে যাবে। এ হাদীছেও উচ্চস্বরে হোক বা নিম্নস্বরে মতলক যিকরের কথা বর্ণিত হয়েছে। মিশকাত শরীফের একই অধ্যায়ে আরও বর্ণিত আছে-
اِذَا مَرَرْتُمْ بِرِيَاضِ الْجَنَّةِ فَارْتَعُوْا قَالُوْا وَمَارِيَاضُ الْجَنَّةِ قَالَ حِلَقُ الذِّكْرِ
হুযূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ ফরমান, যখন তোমরা বেহেশতের বাগান সমূহ অতিক্রম করবে, তখন ওখান থেকে কিছু খেয়ে নিও। সাহাবায়ে কিরাম আরয করলেন, বেহেশতের বাগান কোথায়? ফরমালেন যিকরের মাহফিল ।
এতে প্রমাণিত হলো যে, মইয়তের সাথে যদি যিকরে ইলাহী করতে করতে যাওয়া হয়, তাহলে মইয়ত বেহেশতের বাগানের মধ্যে দিয়ে কবরস্থানে যাবে। উল্লেখ্য যে এখানেও মতলক যিকরের কথা বর্ণিত হয়েছে। মিশকাত শরীফের একই অধ্যায়ে আরও বর্ণিত আছে-
اَلشَّيْطنُ جَاثِمٌ عَلى قَلْبِ اِبْنِ اَدَمَ فَاِذَا ذَكَرَ اللهَ خَنَسَ
(শয়তান মানুষের আত্মার সাথে লেপটে থাকে। যখন মানুষ আল্লাহর যিকর করে তখন সরে যায়।) বোঝা গেল- মইয়তকে নিয়ে যাবার সময় আল্লাহর যিকর করা হলে মইয়ত শয়তান থেকে রেহাই পাবে। এখানেও উচ্চস্বর বা নিম্নস্বরের কোন শর্তারোপ করা হয়নি। এ পর্যন্ত জানাযার আগে উচ্চস্বরে যিকরকে কুরআন হাদীছের দলীল দ্বারা প্রমান করা হলো।
এবার বিভিন্ন ফকীহগণের মতামতের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন, যেথায় এর বিশ্লেষণ মিলে। প্রসিদ্ধ حديقه نديه شرح محمديه কিতাবে ইমাম আবদুল গণী নাবলুসী (রহঃ) এ মাস্আলার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন- যেসব ফকীহ জানাযার সাথে উচ্চস্বরে যিকর নিষেধ করেন, তা নিশ্চয় মাকরূহ তানযীহ বা মাকরূহ তাহরীমীর ভিত্তিতেই করেন। অতঃপর তিনি বলেন-
(কিন্তু কতেক মাশায়েখ জানাযার আগে পিছে উচ্চস্বরে যিকর করাকে জায়েয বলেছেন। যাতে এর দ্বারা মৃত ও জীবিতদের তলকীন হয়ে যায় এবং অলস ব্যক্তিদের অন্তর থেকে অলসতা ও পার্থিব মহব্বত দূরীভূত হয়।)
কুতুবে রব্বানী ইমাম শায়ারানী (রহঃ) বলেন-
(হযরত আলীউল খওয়াস (রাঃ) বলতেন- যখন দেখা গেল যে, শবযাত্রীরা বাজে কথাবার্তা ত্যাগ করে না এবং দুনিয়াবী ধ্যান ধারণায় ব্যস্ত থাকে, তখন ওদেরকে কলেমা পড়ার হুকুম দেয়া উচিৎ। কেননা এ কলেমা পড়া না পড়ার থেকে উত্তম এবং সুস্পষ্ট দলীল ও অধিকাংশ মুসলমানের অভিমত ব্যতীত ফকীহ আলিমদের কর্তৃক একে অস্বীকার করা অনুচিত। এ জন্যে শারেহ (আঃ) এর পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি কলেমা পড়ার সাধারণ অনুমতি রয়েছে- যে কোন সময় ইচ্ছা করলে পড়তে পারে। দারুণ আশ্চর্য লাগে ওই সব অন্ধদের মনমানসিকতায়, যারা একে অস্বীকার করে। (ইমাম শায়ারানী তাঁর অন্য আর এক কিতাব
عهود المشائخ এ বর্ণনা করেন-
আমি আমার ভাইদের মধ্যে কাউকে এমন কোন কিছুকে অস্বীকার করার সুযোগ দিব না, যেটা মুসলমানগণ ছওয়াব মনে করে আবিস্কার করেছে এবং একে ভাল মনে করে, বিশেষ করে সে ধরনের কিছু, যেটা আল্লাহ তা’আলা ও রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) সাথে সম্পর্কিত। যেমন জনগণ জানাযার আগে কলেমা পড়ে বা জানাযার আগে কুরআন পাঠ করে। যে ব্যক্তি একে হারাম বলে, সে শরীয়ত সম্পর্কে অজ্ঞ। তিনি আরও বলেন-
(কলেমায়ে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদার রসুলুল্লাহ’ সমস্ত নেকীর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম নেকী। সুতরাং এর থেকে কিভাবে নিষেধ করা যেতে পারে। যদি আপনারা আজ কাল জনগণের অবস্থা মনোযোগ সহকারে লক্ষ করেন, তাহলে ওদেরকে জানাযার সাথে যাবার সময় পার্থিব গল্প গুজবে ব্যস্ত দেখবেন; তাদের মন মইয়ত থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না এবং যা কিছু হয়েছে তা থেকে উদাসীন বরং অনেক লোককে আমি হাসিঠাট্রা করতে দেখেছি। যখন এ যুগে জনগণের এ অবস্থা, তখন প্রথম যুগে মইয়তের সাথে উচ্চস্বরে কালেমা পড়া হতো না হেতু নাজায়েয বলে হুকুম দেয়া দুরস্ত নয়, বরং জায়েয হওয়ার হুকুম দেয়াটাই বাঞ্ছনীয়। এবং জানাযায় ঘরসংসারের কথাবার্তার চেয়ে অন্য কথা ভাল। তাই যদি সবাই জানাযায় উচ্চস্বরে কলেমা পড়ে, এতে আমাদের কোন আপত্তি নেই।)
উপরোক্ত ভাষ্য থেকে বোঝা গেল জানাযার সাথে যদি উচ্চস্বরে যিকর করা হয়, তা জায়েয। বিশেষ করে বর্তমান যুগে সাধারণ লোকের যখন মইয়তের সাথে হাসিঠাট্রা করে ও দুনিয়াবী কথাবার্তা বলে গমন করে, তখন তাদের সবাইকে যিকরে ইলাহীতে নিয়োজিত করা অনেক ভাল; এটা দুনিয়াবী কথাবার্তা থেকে অনেক উত্তম। -সুত্রঃ জা’আল হক ২য় খন্ড-
اَلَّذِيْنَ يَذْكُرَوْنَ اللهَ قِيَامًا وَّقُعُوْدًا وَّعَلى جُنُوْبِهِمْ
(যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফ্সীরে রূহুল বয়ানে বর্ণিত আছে-
اَىْ يَذْكُرُوْنَهُ دَائِمًا عَلى الْحَالَاتِ كُلِّهَا قَائِمِيْنَ وَقَائِدِيْنَ وَمُضْطَجِعِيْنَ فَاِنَّ الْاِنْسَانَ لَايَخْلُوْا عَنْ هذِهِ الْهَيْئَاتِ غَالبًا
এ আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে যে কোন অবস্থায় দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে সব সময় আল্লাহর যিকর করা। কেননা মানুষ অধিকাংশ সময় এ তিন অবস্থা থেকে মুক্ত থাকে না।
তাফ্সীরে আবুস সউদে এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে বর্ণিত আছে-
وَالْمُرَادُ تَعْمِيْمُ الذِّكْرِ لِلْاَوْقَاتِ وَتَحْصِيْصُ الْاَحْوَالِ الْمَذْكُوْرَةِ لَيْسَ لِتَخْصِيْصِ الذِّكْرِ بِهَا بَلْ لِاَنَّهَا الْاَحْوَالُ الْمَعْهُوْدَةَ الَّتِىْ لَايَخْلُوْا عَنْهَا الْاِنْسَانُ
(এর অর্থ প্রায় উপরোক্ত তাফ্সীরের মত) তাফ্সীরে কবীরে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত আছে- (এর অর্থ উপরোক্ত তাফ্সীরের মত) আল্লামা ইবনে আদী ‘কামেল’ গ্রন্থে এবং ইমাম যায়লয়ী (রাঃ)- نصت الراية لتخريج احاديث الهداية নামক কিতাবের ২৯২ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন-
عَنْ اِبْنِ عُمَرَ قَالَ لَمْ يَكُنْ يَسْمَعُ مِنْ رَّسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَمْشِىْ خَلْفَ الْجَنَازَةِ اِلَّا قَوْلَ لَااِلهَ اِلَّا اللهُ مبْدِيا ورَاجِعًا
এ হাদীছটা জয়ীফ হলেও ফজায়েলে আমালের ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। মিসরী ছাপা তাহযিরুল মুখতার আলা রদ্দুল মুখতার কিতাবের ১২৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছে-
উপরোক্ত আয়াত এবং এর তাফ্সীর সমূহ ও হাদীছ সমূহ থেকে দু’টি বিষয় জানা গেল- সর্বাবস্থায় যিকরে ইলাহীর অনুমতি রয়েছে এবং উচ্চস্বরে বা নিম্নস্বরে যে কোনভাবে জায়েয। এখন কোন উপলক্ষে যিকর নিষেধ করার জন্য অন্ততঃ পক্ষে প্রসিদ্ধ হাদীছের প্রয়োজন। কেননা একক হাদীছ বা মুজতাহিদের অনুমান দ্বারা কুরআনের অনির্দিষ্ট হুকুমের নির্দিষ্ট করা যায় না। ফকীহগণ জনাবত ও ঋতুস্রাবের সময়ও কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া সমস্ত যিকর জায়েয বলেছেন এবং কুরআনের আয়াত যদি তেলাওয়াতের নিয়ত ছাড়া পাঠ করা হয়, তাও জায়েয (ফিকহ শাস্ত্রের প্রায় তিকাব দ্রষ্টব্য) তাহলে মইয়তকে কবরস্থানে নিয়ে যাবার সময়টা একটি অবস্থা বিধায়, তখনও সব রকম যিকর জায়েয। কুরআন ইরশাদ ফরমান- اَلَا بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنَّ الْقُلُوْبُ (জেনে রেখ, আল্লাহর স্মরণে চিত্ত প্রশান্ত হয়।) এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রূহুল বয়ানের রচয়িতা বলেন-
মুসলমানগণ কুরআন পাঠ এবং যিকরে ইলাহী (ইসমে আযম) দ্বারা তৃপ্তি লাভ করে এবং শুনতে পছন্দ করে। আর কাপিরগণ দুনিয়াদারীতে তৃপ্ত এবং গায়রুল্লাহর প্রশংসায় আনন্দ লাভ করে।
এ আয়াত ও তাফ্সীরের ভাষ্য থেকে বোঝা গেল- আল্লাহর যিকর মুসলমানের জন্য আনন্দ ও তৃপ্তিদায়ক কিন্তু কাফিরদের জন্য বেদনাদায়ক। খোদার শুকর, মইয়তও মুসলমান এবং সমস্ত শবযাত্রীরাও মুসলমান। সবাই এতে তৃপ্তি পাবে। অধিকন্তু ওই সময় আত্মীয় স্বজন থেকে চির বিদায়ের কারণে মইয়তের মন ভারাক্রান্ত থাকে। তখন এ ধরনের যিকরের দ্বারা পেরেশানী দূরীভূত হয়। লক্ষণীয় যে এ আয়াতে মতলক যিকরের কথা বর্ণিত হয়েছে- উচ্চস্বরে হোক বা নিম্নস্বরে হোক। সুতরাং প্রত্যেক রকম যিকর জায়েয প্রমাণিত হলো। কেবল নিজস্ব রায় দ্বারা এতে শর্তারোপ করা যাবে না।
منتخب كنز العمال কিতাবের ষষ্ঠ খন্ডের ৯৯ পৃষ্ঠায় আনস (রাঃ) এর বরাত দিয়ে বর্ণিত আছে-
اَكْثِرُوْا فِى الْجَنَازَةِ قَوْلَ لَا اِلهَ اِلَّا اللهُ
(জানাযায় বেশী করে কলেমা তৈয়্যবা পড়ুন) মিশকাত শরীফের কিতাবুল দাওয়াতে যিকরুল্লাহ’ শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
اِنَّ اللهِ مَلَئِكَةَ يَطُوْفُوْنَ ِفِى الطُّرُقِ يَلْتَمِسُوْنَ اَهْلَ الذِّكْرِ فَاِذَا وَجَدُوْا قَوْمًا يَذْكُرُوْنَ اللهَ تَنَادُوْا هَلُمُّوْا اِلَى حَاجَتِكُمْ قَالَ فَيُحِفُّوْلَهُمْ بِاَجْنِهْتِهِمْ
(আল্লাহর কিছু ফিরিশ্তা রাস্তায় টহল দেয় এবং আল্লাহর যিকরকারীদেরকে অনুসন্ধান করে। যখন কোন জনগোষ্ঠিকে যিকর করতে দেখে, তখন একে অপরকে ডাকাডাকি করে বলে- নিজেদের উদ্দেশ্যের প্রতি আগোয়ান হও। অতঃপর ওই সব যিকরকারীদেরকে পালক দ্বারা আচ্ছাদিত করে নেয়।) সুতরাং মইয়তের লোকেরা যদি আল্লাহর যিকর করতে করতে যায়, তাহলে টহলরত ফিরিশ্তাদের সাক্ষাত মিলবে। তখন সবাইকে পালক দ্বারা আচ্ছাদিত করে নিবে। মইয়তও ফিরিশ্তাদের পালকের ছায়ায় কবরস্থানে পৌঁছে যাবে। এ হাদীছেও উচ্চস্বরে হোক বা নিম্নস্বরে মতলক যিকরের কথা বর্ণিত হয়েছে। মিশকাত শরীফের একই অধ্যায়ে আরও বর্ণিত আছে-
اِذَا مَرَرْتُمْ بِرِيَاضِ الْجَنَّةِ فَارْتَعُوْا قَالُوْا وَمَارِيَاضُ الْجَنَّةِ قَالَ حِلَقُ الذِّكْرِ
হুযূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ ফরমান, যখন তোমরা বেহেশতের বাগান সমূহ অতিক্রম করবে, তখন ওখান থেকে কিছু খেয়ে নিও। সাহাবায়ে কিরাম আরয করলেন, বেহেশতের বাগান কোথায়? ফরমালেন যিকরের মাহফিল ।
এতে প্রমাণিত হলো যে, মইয়তের সাথে যদি যিকরে ইলাহী করতে করতে যাওয়া হয়, তাহলে মইয়ত বেহেশতের বাগানের মধ্যে দিয়ে কবরস্থানে যাবে। উল্লেখ্য যে এখানেও মতলক যিকরের কথা বর্ণিত হয়েছে। মিশকাত শরীফের একই অধ্যায়ে আরও বর্ণিত আছে-
اَلشَّيْطنُ جَاثِمٌ عَلى قَلْبِ اِبْنِ اَدَمَ فَاِذَا ذَكَرَ اللهَ خَنَسَ
(শয়তান মানুষের আত্মার সাথে লেপটে থাকে। যখন মানুষ আল্লাহর যিকর করে তখন সরে যায়।) বোঝা গেল- মইয়তকে নিয়ে যাবার সময় আল্লাহর যিকর করা হলে মইয়ত শয়তান থেকে রেহাই পাবে। এখানেও উচ্চস্বর বা নিম্নস্বরের কোন শর্তারোপ করা হয়নি। এ পর্যন্ত জানাযার আগে উচ্চস্বরে যিকরকে কুরআন হাদীছের দলীল দ্বারা প্রমান করা হলো।
এবার বিভিন্ন ফকীহগণের মতামতের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন, যেথায় এর বিশ্লেষণ মিলে। প্রসিদ্ধ حديقه نديه شرح محمديه কিতাবে ইমাম আবদুল গণী নাবলুসী (রহঃ) এ মাস্আলার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন- যেসব ফকীহ জানাযার সাথে উচ্চস্বরে যিকর নিষেধ করেন, তা নিশ্চয় মাকরূহ তানযীহ বা মাকরূহ তাহরীমীর ভিত্তিতেই করেন। অতঃপর তিনি বলেন-
(কিন্তু কতেক মাশায়েখ জানাযার আগে পিছে উচ্চস্বরে যিকর করাকে জায়েয বলেছেন। যাতে এর দ্বারা মৃত ও জীবিতদের তলকীন হয়ে যায় এবং অলস ব্যক্তিদের অন্তর থেকে অলসতা ও পার্থিব মহব্বত দূরীভূত হয়।)
কুতুবে রব্বানী ইমাম শায়ারানী (রহঃ) বলেন-
(হযরত আলীউল খওয়াস (রাঃ) বলতেন- যখন দেখা গেল যে, শবযাত্রীরা বাজে কথাবার্তা ত্যাগ করে না এবং দুনিয়াবী ধ্যান ধারণায় ব্যস্ত থাকে, তখন ওদেরকে কলেমা পড়ার হুকুম দেয়া উচিৎ। কেননা এ কলেমা পড়া না পড়ার থেকে উত্তম এবং সুস্পষ্ট দলীল ও অধিকাংশ মুসলমানের অভিমত ব্যতীত ফকীহ আলিমদের কর্তৃক একে অস্বীকার করা অনুচিত। এ জন্যে শারেহ (আঃ) এর পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি কলেমা পড়ার সাধারণ অনুমতি রয়েছে- যে কোন সময় ইচ্ছা করলে পড়তে পারে। দারুণ আশ্চর্য লাগে ওই সব অন্ধদের মনমানসিকতায়, যারা একে অস্বীকার করে। (ইমাম শায়ারানী তাঁর অন্য আর এক কিতাব
عهود المشائخ এ বর্ণনা করেন-
আমি আমার ভাইদের মধ্যে কাউকে এমন কোন কিছুকে অস্বীকার করার সুযোগ দিব না, যেটা মুসলমানগণ ছওয়াব মনে করে আবিস্কার করেছে এবং একে ভাল মনে করে, বিশেষ করে সে ধরনের কিছু, যেটা আল্লাহ তা’আলা ও রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) সাথে সম্পর্কিত। যেমন জনগণ জানাযার আগে কলেমা পড়ে বা জানাযার আগে কুরআন পাঠ করে। যে ব্যক্তি একে হারাম বলে, সে শরীয়ত সম্পর্কে অজ্ঞ। তিনি আরও বলেন-
(কলেমায়ে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদার রসুলুল্লাহ’ সমস্ত নেকীর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম নেকী। সুতরাং এর থেকে কিভাবে নিষেধ করা যেতে পারে। যদি আপনারা আজ কাল জনগণের অবস্থা মনোযোগ সহকারে লক্ষ করেন, তাহলে ওদেরকে জানাযার সাথে যাবার সময় পার্থিব গল্প গুজবে ব্যস্ত দেখবেন; তাদের মন মইয়ত থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না এবং যা কিছু হয়েছে তা থেকে উদাসীন বরং অনেক লোককে আমি হাসিঠাট্রা করতে দেখেছি। যখন এ যুগে জনগণের এ অবস্থা, তখন প্রথম যুগে মইয়তের সাথে উচ্চস্বরে কালেমা পড়া হতো না হেতু নাজায়েয বলে হুকুম দেয়া দুরস্ত নয়, বরং জায়েয হওয়ার হুকুম দেয়াটাই বাঞ্ছনীয়। এবং জানাযায় ঘরসংসারের কথাবার্তার চেয়ে অন্য কথা ভাল। তাই যদি সবাই জানাযায় উচ্চস্বরে কলেমা পড়ে, এতে আমাদের কোন আপত্তি নেই।)
উপরোক্ত ভাষ্য থেকে বোঝা গেল জানাযার সাথে যদি উচ্চস্বরে যিকর করা হয়, তা জায়েয। বিশেষ করে বর্তমান যুগে সাধারণ লোকের যখন মইয়তের সাথে হাসিঠাট্রা করে ও দুনিয়াবী কথাবার্তা বলে গমন করে, তখন তাদের সবাইকে যিকরে ইলাহীতে নিয়োজিত করা অনেক ভাল; এটা দুনিয়াবী কথাবার্তা থেকে অনেক উত্তম। -সুত্রঃ জা’আল হক ২য় খন্ড-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thaks for watching www.sunnihaque.blogspot.com