মুসলমান মারা যাবার পর তিন আবস্থায় থাকে। ১। জানাযার নামাযের আগে, ২। জানাযার নামাযের পর ও দাফনের আগে এবং ৩। দাফনের পর। এ তিন অবস্থায় মৃতব্যক্তির জন্য দুআ ও ঈসালে ছওয়াব করা জায়েয এবং উত্তম। অবশ্য মৃতব্যক্তির গোসলের আগে এর পার্শ্বে বসে কেউ যদি কুরআন পড়তে চান, তাহলে লাশকে ঢেকে রাখবেন, কেননা তখন তা নাপাক। গোসলের পর যে কোন অবস্থায় কুরআন ইত্যাদি পড়তে পারেন। বিরোধীতাকারিরা নামাযের আগে ও দাফনের পরে দুআ ইত্যাদি করা জায়েয মনে করে। কিন্তু নামাযের পর ও দাফনের আগে দুআ করাকে নাজায়েয, হারাম, বিদআত, শিরক আরও কত কিছুইনা বলে। এ অধ্যায়ে এর বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং দুআ করার সমর্থনে প্রমাণ দেয়া হয়েছে । মিশকাত শরফের صلوة الجنازة অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে-
اِذَصَلَّيْتَمْ عَلَى الْمَيِّتِ فَاخْلِصُوْا لَهُ الدُّعَاء
(যখন তোমরা মৃতব্যক্তির জানাযা পড়ে ফেল, তখন তার জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করবে) এখানে ف ফা এর দ্বারা বোঝা যায় যে নামাযের পর যেন অনতিবিলম্বে দুআ করা হয়। যারা উপরোক্ত বাক্যের এ অর্থ করে নামাযের মধ্যে এর জন্য দুআ করা হয়। তারা ف এর অর্থ সম্পর্ক্য অজ্ঞ। আরবী ব্যকরন অনুযায়ি صَلَّيْتُمْ হচ্ছে শর্ত এবং فَاخْلِصُوْ এর জযা। শর্ত ও জযার মধে প্রভেদ থাকা প্রয়োজন; একটা অন্যটার অন্তর্ভক্ত নয় । আর صَلَّيْتُمْ হলো অতীত কাল জ্ঞাপক ক্রিয়া এবং فَاخْلِصُوْا হলো নির্দেশাত্মক তাই বোঝা গেল, নামাজ পড়ার পরই দুআর নির্দেশ রয়েছে। যেমন فاذا طَعِمْتَمْ فَانْتَشِرَوْا যখন খাওয়ার মাঝখানে নয়। এবং اِذَا فُمْتُمْ اِلَ الصَّلَوْاة فَاعْسِلُوْا وجُوْ هَكُمْ যখন নামাজের জন্য দাঁড়াবে, তখন তোমাদের মুখ ধৌত কর। এতে নামাজের জন্য তৈরি হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। নামাজের কিয়ামের কথা বলা হয়নি, যা اِلَى অব্যয় দ্বারা প্রতীয়মান হলো আর এখানে নামাজ পড়ার ইচ্ছা পোষণ করার পরই ওযুর কথা বলা হয়েছে। তাই ف (ফা) দ্বারা বিলম্ব অর্থই প্রকাশ পায়। বিনা কারণে আসল অর্থ বাদ দিয়ে রূপক অর্থ গ্রহন করা নাজায়েয। মিসকাত শরীফের একই জায়গায় আরও উল্লেখিত আছে قَرَءَ عَلَى الْجَنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ (হুযুর আলাইহিস সালাম জানাযায় সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন। এর ব্যখ্যা প্রসঙ্গে আশআতুল লুমআত গ্রন্থে উল্লেখিত আছে ।
واحتمال داردكه برجنازه بعد ازنماز پيش ازان بقصد تبرك خوانده باشد چنانكه الان متعارف است.
সম্ভবত : হুযূর আলাইহিস সালাম নামাজের পর বা আগে বরকতের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন। যেমন আজকাল এর প্রচলন দেখা দেয়। এর থেকে বোঝা গেল শেখ আবদুল হক (রহ:) এর যুগেও জানাযার নামাজের আগে ও পরে বরকতের জন্য সূরা পাঠ প্রচলন ছিল। তিনি একে নিষেধ করেননি, বরং এটাকে হাদীছের অনুসরনই বলতে চেয়েছেন ।
প্রসিদ্ধ ফতহুল কাদির গ্রন্থের كتاب الجنائز এর জানাযার নামাজ পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে। হুযুর আলাইহিস সালাম মিম্বরের উপর দাড়িয়ে মুতা যুদ্ধের খবর দিলেন। এর মধ্যে হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রাহ:) এর শাহাদাতের খবর ও দিলেন ।
فَصَلَّى عَلَيْهِ رَسُوْلُ اللَّه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَدعَالَهُ وَقَالَ اِسْتَغْفِرُوْالَهُ
অত:পর তার জানাযার নামাজ পড়লেন এবং তার জন্য দুআ করলেন এবং লোকদেরকে বললেন তোমরাও তার মাগফিরাতের জন্য দুআ কর। উল্লেখিত ইবারতে دَعَا শব্দের আগে ব্যবহৃত و অব্যয় দ্বারা বোঝা যায় যে, এ দুআ নামাজের পরেই করা হয়েছিল মাওয়াহিবে লাদুনিয়া গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ। فِتْمَا اَخْبَرَ مِنَ الْغَيُوْبِ এর ব্যখ্যা প্রসঙ্গে উপরোক্ত ঘটনা হুবহু বর্ননা করার পর বলেছেন ثُمَّ قَالَ اِسْتَغْفِرُوْا اِسْتِغْفِرِوْلَهُ (অত:পর ফরমালেন, মাগফিরাত কামনা করূন) একই রকম হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রাহ:) জানাযার পর দুয়া করেছিলেন। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, জানাযার পর মাগফিরাতের জন্য দুআ করা জায়েয। কনযুল উম্মাল নামক কিতাবে الجنائز শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত ইব্রাহিম হিজরী (রাহ:) থেকে বর্ণিত আছে
قَل رَئَيْتُ اِتْنِ اَوْفَى وَكَانَ مِنْ اَصْحَابِ الشَّجَرَةِ مَاتَتْ اِبْنَتَهُ اِلَى اَنْ قَالَ ثُمَّ كَبَّرَ عَلَيْهَا اَرْ بَعًا ثُمَّ قَامَ بَعْدُ ذَالِكَ قَدَرَ مَا بَيْنَ التَّكْبِيْرَ تَيْنِ وَقَالَ رْ ءَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمِ كَانَ يَصْنَعُ هَكذَا
আমি ইবনে আবু আওফা (রা:) কে দেখেছি, যিনি বায়তুর রিদওয়ানওয়ালে সাহাবী ছিলেন। তাঁর এক কন্যা মারা গিয়েছিল। তিনি তার জানাযার চার তকবীর বলেছিলেন। অত:পর দুই তকবীরের মাঝখানের বিরতির সমপরিমাণ দাঁড়িয়ে দুআ করেছেন এবং বলেছেন আমি হুযুর আলাইহিস সালামের এরকম করতে দেখেছি। বায়হাকী শরীফে বর্ণিত আছে-
وَعَنِ الْمُسَتَظِلِّ ابْنِ حُصَيْنٍ اَنَّ عَلِيَّا صَلَّى عَلَى جَنَازَةِ بَعْدَمَا صَلَّى عَليْهِ
হযরত মুসতাজিল ইবনে হুসাইন থেকে বর্ণিত আছে যে হযরত আলী (রাহ:) একবার এক জানাযার নামাজের পর দুআ প্রার্থনা করেছিলেন। মদুনাতুল কুবারা গ্রন্থে উল্লেখিত আছে-
يَفُوْلُ هَكَذَا كُلَّمَا كَبَّرَ وَ اِذَا كَانَ التَّكْبِيْرُ الْاَ خِرُ قَالَ مِثْلُ ذَالِكَ ثُمَّ يَقُوْلُ اَللهُمَّ ثَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ.
প্রত্যেক তকবীরে এ রকম বলবে। যখন শেষ তকবীর হবে, তখনও অনুরুপ বলবে। অত:পর বলবে আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মদ।
এর থেকে বোঝা গেল, জানাযার নামাজের পর দরূদ শরীফ পাঠ করা যাবে। কাশফুল ইজা নামক গ্রন্থে বর্ণিত আছে-
দাফন করার পূর্বে মৃতব্যক্তির জন্য ফাতিহা ও দুআ প্রার্থণা করা বৈধ। এ রেওয়ায়েত অনুযায়ী আমল করা হয়েছে। খুলাসাতুল ফতেহ কিতাবে ও অনুরুপ বর্ণিত আছে।
শামসুল আয়িম্মা সরখসি (রহ:) রচিত مبسوط
নামকা গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের ৬০ পৃষ্ঠায় غسلالميت শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর একবার এক জানাযার নামাযের পর উপস্তিত হন এবং বলেন -
اِنْ سَبَقْتُمُوْ نِىْ بِالصَّلَوةِ عَلَيْهِ فَلَاتَسْبِقُوْنِىْ بِالدُّعَاءِ.
যদিওবা তোমরা আমার আগে নামাজ পড়ে ফেলেছ, কিন্তু দোয়ার বেলায় আমার আগে যেয়োনা অর্থাৎ এসো, আমার সাথে দুআয় শরীক হও। এ মবসুত কিতাবের একই জায়গায় অর্থাৎ غسل الميت অধ্যায়ে হযরত ইবনে উমর, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাহ:) থেকে প্রমানিত হয়েছে যে তাঁরা জানাযা নামাজের পর দুআ করেছেন এবং উপরোক্ত হাদিছে فَلَا تَسْبِقُوْا এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে ওই দুআর উপর সাহাবায়ে কিরাম আমল করতেন। মাওলানা ফতেহ মুহাম্মদ ছাহেব বুরহানপুরী তাঁর রচিত “মিফতাহুস সালাত” গ্রন্থের ১১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন -
অর্থাৎ যখন জানাযার নামাজ শেষ হবে, তখন এটা মুস্তাহাব যে ইমাম বা অন্য কোন নেককার ব্যক্তি সূরা বাকারার প্রথম রুকু مُفْلِحُوْنَ পর্যন্ত মইয়তের শিয়রে এবং শেষ আয়াত اَمَنَالرَّسُوْلُ মৃতব্যক্তির বাম পাশে পাঠ করবেন। কেননা এরকম হাদিছ শরীফে বর্ণিত আছে। কতেক হাদিছে দাফনের পরে এ রকম করার কথা উল্লেখ আছে। সম্ভব হলে উভয় সময় পড়া জায়েয আছে।
যাদুল আখিরাত‘ গ্রন্থে নাহারুল ফায়েক শরহে কনযুদ দাকায়েক ও বাহরে জুখখার থেকে উদ্ধৃত করেছেন-
بعداز سلام بخواند اَللهُمَّ لَا تحْرِمْنَا اَجْرَهُ وَ لَا تَفْتِنَا بَعْدَهُ وَالغْفِرْ لَنَا وَلَهُ
সালাম ফিরানোর পর এ দুআটা পড়বেন। اَللهُمَّ لَا تحْرِمْنَا الخ অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাদেরকে এর ছওয়াব থেকে বঞ্চিত করবেন না এবং এরপরে আমাদেরকে ফিৎনা ফ্যাসাদে ফেলো না। আমাদেরকে ও তাকে ক্ষমা করুন। তাহতাবী শরীফে বর্ণিত আছে
وَاِنَّ اَبَاحَنِيْفَةَ لْمَّا مًاتَ فَخُتِمَ عَلَيْهِ سَبْعُوْنَ الفا فَبْل الدَّفْنِ
আবু হানিফা (রাহ:) ইন্তিকাল ফরমান, তখন দাফণের আগে তাঁর জন্য সত্তর হাজার বার কুরআন খতম করা হয়।
কাশফুল গুম্মা ফতওয়ায়ে আলমগীর ও শামীর الدفن অধ্যায়ের تعزيت শীর্ষক আলোচনার উল্লেখিত আছে
وَهِىَ بَعْدَ الدَّفْنِ اَوْلَى مِنْهَا قَبْلَهُ
দাফনের আগে চেয়ে দাফনের পরে শোক প্রকাশ করাটা উত্তম। একই জায়গায় শামী ও আলমগীরীতে আরও উল্লেখিত আছে-
وَهَذَا اِذَا لَمْ يُرَ مِنْهُمْ جَزْ عشَدِيْدً وَّاِلَّا قُدِّمَتْ
এটা যেহেতু এ জন্য যে ওর পরিবার পরিজনের মন যাতে খুব বেশি রকম ভেংগে না পড়ে। অন্যথায় দাফনের আগে শোক প্রকাশ করা যেতে পারে । হুসনে জহিরিয়াতে বর্ণিত আছে
وَهِىَ بَعْدُ الدَّفْنِ اَوْلَى مِنْهَا فَبْلَهُ.
দাফনের আগে থেকে পরে সমবেদনা জ্ঞাপন করা উত্তম ।
ইমাম শারানী (রহ:) রচিত মীজানুল কুবরা গ্রন্থে বর্ণিত আছে -
قَالَ اَبُوْ حَنِيْفَةَ وَالثَّوْ رِىُّ اَنَّ التَّعْزِيَةِ سُنَّةً قَبْلُ الدَّفْنِ لَابَعْدَهُ لِاَنَّ شِدَّةَ الْحُزْنِ تَكَوْنُ قَبْلَ الدَّفْنِ فَيُعَزَّى وَيَدْعُوْا لَهُ.
ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম ছওরী (রা:) বলেন যে দাফনের পরে নয় দাফনের আগে সমবেদনা জ্ঞাপন করা সুন্নত। কেননা দাফনের আগে বিরহ বেদনাটা বেশি থাকে, সুতরাং (দাফনের আগে) শোক প্রকাশ করবেন এবং মইয়তের জন্য দুআ প্রার্থনা করা হয়।
উপরোক্ত ভাষ্য থেকে প্রমানিত হয় যে দাফনের আগে, নামাযের আগে বা পড়ে হোক, শোক প্রকাশ করা জায়েয এবং সুন্নাত । আর সমবেদনায় মৃতব্যক্তি ও তার উত্তরাধিকারীর জন্য যথাক্রমে ছওয়াব ও ধৈর্যের জন্যইতো দুআ করা হয়। বিবেকও বলে যে নামাযে জানাযার পর দুআ জায়েয। কেননা নামাযে জানাযা এক হিসেবে দুআ বিশেষ, কারন এতে মৃতব্যক্তিকে সামনে রাখা হয় এবং এতে রুকু সিজদা তাশাহুদ ইত্যদি নেই। আবার আর এক হিসাবে নামাযও বলা যায় । কারন এর জন্য গোসল, ওযু সতর ডাকা কিবলামুখি হওয়া জায়গা ও কাপড় পাক করা বাঞ্ছনীয় এবং জামাত সহকারে পড়া সুন্নাত। যদি এটা কেবল দুআই হতো, তাহলে নামাযের মত এসব শর্তসমুহ কেন আরোপ হলো ? অন্যান্য দুআর মত যে কোন প্রকারে আদায় করলেয় হয়ে যেত। তাই স্বীকার করতেই হবে যে এটা এক হিসাবে নামাযও এবং প্রত্যেক নামাযের পর দুআ প্রার্থনা করা সুন্নাত ও কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশী । যেমন মিসকাত শরীফে- اَلذِّكْرُ بَعْدُ الصَّلَوةِ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
قِيْلَ يَارَ سُوْلَ اللهِ اَىُّ الدُّعَاءِ اَسْمَعُ قَالَ جَوْقَ اللَّيْلِ الْاَخِرِ وَدَبْرَ الصَّلواة الْمَكْتُوْبَاتِ
হুযুর আলাইহিস সালামের সমীপে আরজ করা হয়েছিল কোন দু’আটি বেশি কবুল হয়। তিনি এরশাদ ফরমান শেষ রাত্রির মধ্যবর্তী সময় ও ফরজ নামাজ সমুহের পরে জানাযার নামাজও ফরজ । তাই এর পর দু’আ কেন করা যাবে না ? অধিকন্তু যে কোন সময় দুআ প্রার্থনা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং। অনেক গুরুত্বরোপ করা হয়েছে। মিসকাত শরীফের কিতাবুদ দাওয়াতে বর্ণিত আছে الدُّعاءُ هُوَالْعِبَادَةُ দুআ এক প্রকার এবাদত একই জায়গায় এটাও উল্লেখ আছে الدُّعَاءُ مُخّ الْعِبَادَةِ দুআ ইবাদতের মুল। দুয়া প্রার্থনা করার জন্য সময় কালের কোন বিধি নিষেধ নেয়। তাহলে এটার কি কারন থাকতে পারে যে জানাযার আগে ও দাফনের পরে দুআ করা জায়েয। কিন্তু নামাজের পড়ে ও সাথে দুআ ও ইছালে ছওয়াব হারাম হয়ে গেল এবং পর ওই যাদু অপসারিত হলো ও সব কিছু হালাল হয়ে গেল । যে কোন সময় দুআ প্রার্থনা ও ইছালে ছওয়াব জায়েয, এর জন্য কোন সময়ের বিধি নিষেধ নেয় । -সূত্রঃ জা’আল হক ২য় খন্ড-
اِذَصَلَّيْتَمْ عَلَى الْمَيِّتِ فَاخْلِصُوْا لَهُ الدُّعَاء
(যখন তোমরা মৃতব্যক্তির জানাযা পড়ে ফেল, তখন তার জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করবে) এখানে ف ফা এর দ্বারা বোঝা যায় যে নামাযের পর যেন অনতিবিলম্বে দুআ করা হয়। যারা উপরোক্ত বাক্যের এ অর্থ করে নামাযের মধ্যে এর জন্য দুআ করা হয়। তারা ف এর অর্থ সম্পর্ক্য অজ্ঞ। আরবী ব্যকরন অনুযায়ি صَلَّيْتُمْ হচ্ছে শর্ত এবং فَاخْلِصُوْ এর জযা। শর্ত ও জযার মধে প্রভেদ থাকা প্রয়োজন; একটা অন্যটার অন্তর্ভক্ত নয় । আর صَلَّيْتُمْ হলো অতীত কাল জ্ঞাপক ক্রিয়া এবং فَاخْلِصُوْا হলো নির্দেশাত্মক তাই বোঝা গেল, নামাজ পড়ার পরই দুআর নির্দেশ রয়েছে। যেমন فاذا طَعِمْتَمْ فَانْتَشِرَوْا যখন খাওয়ার মাঝখানে নয়। এবং اِذَا فُمْتُمْ اِلَ الصَّلَوْاة فَاعْسِلُوْا وجُوْ هَكُمْ যখন নামাজের জন্য দাঁড়াবে, তখন তোমাদের মুখ ধৌত কর। এতে নামাজের জন্য তৈরি হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। নামাজের কিয়ামের কথা বলা হয়নি, যা اِلَى অব্যয় দ্বারা প্রতীয়মান হলো আর এখানে নামাজ পড়ার ইচ্ছা পোষণ করার পরই ওযুর কথা বলা হয়েছে। তাই ف (ফা) দ্বারা বিলম্ব অর্থই প্রকাশ পায়। বিনা কারণে আসল অর্থ বাদ দিয়ে রূপক অর্থ গ্রহন করা নাজায়েয। মিসকাত শরীফের একই জায়গায় আরও উল্লেখিত আছে قَرَءَ عَلَى الْجَنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ (হুযুর আলাইহিস সালাম জানাযায় সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন। এর ব্যখ্যা প্রসঙ্গে আশআতুল লুমআত গ্রন্থে উল্লেখিত আছে ।
واحتمال داردكه برجنازه بعد ازنماز پيش ازان بقصد تبرك خوانده باشد چنانكه الان متعارف است.
সম্ভবত : হুযূর আলাইহিস সালাম নামাজের পর বা আগে বরকতের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন। যেমন আজকাল এর প্রচলন দেখা দেয়। এর থেকে বোঝা গেল শেখ আবদুল হক (রহ:) এর যুগেও জানাযার নামাজের আগে ও পরে বরকতের জন্য সূরা পাঠ প্রচলন ছিল। তিনি একে নিষেধ করেননি, বরং এটাকে হাদীছের অনুসরনই বলতে চেয়েছেন ।
প্রসিদ্ধ ফতহুল কাদির গ্রন্থের كتاب الجنائز এর জানাযার নামাজ পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে। হুযুর আলাইহিস সালাম মিম্বরের উপর দাড়িয়ে মুতা যুদ্ধের খবর দিলেন। এর মধ্যে হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রাহ:) এর শাহাদাতের খবর ও দিলেন ।
فَصَلَّى عَلَيْهِ رَسُوْلُ اللَّه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَدعَالَهُ وَقَالَ اِسْتَغْفِرُوْالَهُ
অত:পর তার জানাযার নামাজ পড়লেন এবং তার জন্য দুআ করলেন এবং লোকদেরকে বললেন তোমরাও তার মাগফিরাতের জন্য দুআ কর। উল্লেখিত ইবারতে دَعَا শব্দের আগে ব্যবহৃত و অব্যয় দ্বারা বোঝা যায় যে, এ দুআ নামাজের পরেই করা হয়েছিল মাওয়াহিবে লাদুনিয়া গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ। فِتْمَا اَخْبَرَ مِنَ الْغَيُوْبِ এর ব্যখ্যা প্রসঙ্গে উপরোক্ত ঘটনা হুবহু বর্ননা করার পর বলেছেন ثُمَّ قَالَ اِسْتَغْفِرُوْا اِسْتِغْفِرِوْلَهُ (অত:পর ফরমালেন, মাগফিরাত কামনা করূন) একই রকম হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রাহ:) জানাযার পর দুয়া করেছিলেন। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, জানাযার পর মাগফিরাতের জন্য দুআ করা জায়েয। কনযুল উম্মাল নামক কিতাবে الجنائز শীর্ষক অধ্যায়ে হযরত ইব্রাহিম হিজরী (রাহ:) থেকে বর্ণিত আছে
قَل رَئَيْتُ اِتْنِ اَوْفَى وَكَانَ مِنْ اَصْحَابِ الشَّجَرَةِ مَاتَتْ اِبْنَتَهُ اِلَى اَنْ قَالَ ثُمَّ كَبَّرَ عَلَيْهَا اَرْ بَعًا ثُمَّ قَامَ بَعْدُ ذَالِكَ قَدَرَ مَا بَيْنَ التَّكْبِيْرَ تَيْنِ وَقَالَ رْ ءَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمِ كَانَ يَصْنَعُ هَكذَا
আমি ইবনে আবু আওফা (রা:) কে দেখেছি, যিনি বায়তুর রিদওয়ানওয়ালে সাহাবী ছিলেন। তাঁর এক কন্যা মারা গিয়েছিল। তিনি তার জানাযার চার তকবীর বলেছিলেন। অত:পর দুই তকবীরের মাঝখানের বিরতির সমপরিমাণ দাঁড়িয়ে দুআ করেছেন এবং বলেছেন আমি হুযুর আলাইহিস সালামের এরকম করতে দেখেছি। বায়হাকী শরীফে বর্ণিত আছে-
وَعَنِ الْمُسَتَظِلِّ ابْنِ حُصَيْنٍ اَنَّ عَلِيَّا صَلَّى عَلَى جَنَازَةِ بَعْدَمَا صَلَّى عَليْهِ
হযরত মুসতাজিল ইবনে হুসাইন থেকে বর্ণিত আছে যে হযরত আলী (রাহ:) একবার এক জানাযার নামাজের পর দুআ প্রার্থনা করেছিলেন। মদুনাতুল কুবারা গ্রন্থে উল্লেখিত আছে-
يَفُوْلُ هَكَذَا كُلَّمَا كَبَّرَ وَ اِذَا كَانَ التَّكْبِيْرُ الْاَ خِرُ قَالَ مِثْلُ ذَالِكَ ثُمَّ يَقُوْلُ اَللهُمَّ ثَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ.
প্রত্যেক তকবীরে এ রকম বলবে। যখন শেষ তকবীর হবে, তখনও অনুরুপ বলবে। অত:পর বলবে আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মদ।
এর থেকে বোঝা গেল, জানাযার নামাজের পর দরূদ শরীফ পাঠ করা যাবে। কাশফুল ইজা নামক গ্রন্থে বর্ণিত আছে-
দাফন করার পূর্বে মৃতব্যক্তির জন্য ফাতিহা ও দুআ প্রার্থণা করা বৈধ। এ রেওয়ায়েত অনুযায়ী আমল করা হয়েছে। খুলাসাতুল ফতেহ কিতাবে ও অনুরুপ বর্ণিত আছে।
শামসুল আয়িম্মা সরখসি (রহ:) রচিত مبسوط
নামকা গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের ৬০ পৃষ্ঠায় غسلالميت শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর একবার এক জানাযার নামাযের পর উপস্তিত হন এবং বলেন -
اِنْ سَبَقْتُمُوْ نِىْ بِالصَّلَوةِ عَلَيْهِ فَلَاتَسْبِقُوْنِىْ بِالدُّعَاءِ.
যদিওবা তোমরা আমার আগে নামাজ পড়ে ফেলেছ, কিন্তু দোয়ার বেলায় আমার আগে যেয়োনা অর্থাৎ এসো, আমার সাথে দুআয় শরীক হও। এ মবসুত কিতাবের একই জায়গায় অর্থাৎ غسل الميت অধ্যায়ে হযরত ইবনে উমর, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাহ:) থেকে প্রমানিত হয়েছে যে তাঁরা জানাযা নামাজের পর দুআ করেছেন এবং উপরোক্ত হাদিছে فَلَا تَسْبِقُوْا এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে ওই দুআর উপর সাহাবায়ে কিরাম আমল করতেন। মাওলানা ফতেহ মুহাম্মদ ছাহেব বুরহানপুরী তাঁর রচিত “মিফতাহুস সালাত” গ্রন্থের ১১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন -
অর্থাৎ যখন জানাযার নামাজ শেষ হবে, তখন এটা মুস্তাহাব যে ইমাম বা অন্য কোন নেককার ব্যক্তি সূরা বাকারার প্রথম রুকু مُفْلِحُوْنَ পর্যন্ত মইয়তের শিয়রে এবং শেষ আয়াত اَمَنَالرَّسُوْلُ মৃতব্যক্তির বাম পাশে পাঠ করবেন। কেননা এরকম হাদিছ শরীফে বর্ণিত আছে। কতেক হাদিছে দাফনের পরে এ রকম করার কথা উল্লেখ আছে। সম্ভব হলে উভয় সময় পড়া জায়েয আছে।
যাদুল আখিরাত‘ গ্রন্থে নাহারুল ফায়েক শরহে কনযুদ দাকায়েক ও বাহরে জুখখার থেকে উদ্ধৃত করেছেন-
بعداز سلام بخواند اَللهُمَّ لَا تحْرِمْنَا اَجْرَهُ وَ لَا تَفْتِنَا بَعْدَهُ وَالغْفِرْ لَنَا وَلَهُ
সালাম ফিরানোর পর এ দুআটা পড়বেন। اَللهُمَّ لَا تحْرِمْنَا الخ অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাদেরকে এর ছওয়াব থেকে বঞ্চিত করবেন না এবং এরপরে আমাদেরকে ফিৎনা ফ্যাসাদে ফেলো না। আমাদেরকে ও তাকে ক্ষমা করুন। তাহতাবী শরীফে বর্ণিত আছে
وَاِنَّ اَبَاحَنِيْفَةَ لْمَّا مًاتَ فَخُتِمَ عَلَيْهِ سَبْعُوْنَ الفا فَبْل الدَّفْنِ
আবু হানিফা (রাহ:) ইন্তিকাল ফরমান, তখন দাফণের আগে তাঁর জন্য সত্তর হাজার বার কুরআন খতম করা হয়।
কাশফুল গুম্মা ফতওয়ায়ে আলমগীর ও শামীর الدفن অধ্যায়ের تعزيت শীর্ষক আলোচনার উল্লেখিত আছে
وَهِىَ بَعْدَ الدَّفْنِ اَوْلَى مِنْهَا قَبْلَهُ
দাফনের আগে চেয়ে দাফনের পরে শোক প্রকাশ করাটা উত্তম। একই জায়গায় শামী ও আলমগীরীতে আরও উল্লেখিত আছে-
وَهَذَا اِذَا لَمْ يُرَ مِنْهُمْ جَزْ عشَدِيْدً وَّاِلَّا قُدِّمَتْ
এটা যেহেতু এ জন্য যে ওর পরিবার পরিজনের মন যাতে খুব বেশি রকম ভেংগে না পড়ে। অন্যথায় দাফনের আগে শোক প্রকাশ করা যেতে পারে । হুসনে জহিরিয়াতে বর্ণিত আছে
وَهِىَ بَعْدُ الدَّفْنِ اَوْلَى مِنْهَا فَبْلَهُ.
দাফনের আগে থেকে পরে সমবেদনা জ্ঞাপন করা উত্তম ।
ইমাম শারানী (রহ:) রচিত মীজানুল কুবরা গ্রন্থে বর্ণিত আছে -
قَالَ اَبُوْ حَنِيْفَةَ وَالثَّوْ رِىُّ اَنَّ التَّعْزِيَةِ سُنَّةً قَبْلُ الدَّفْنِ لَابَعْدَهُ لِاَنَّ شِدَّةَ الْحُزْنِ تَكَوْنُ قَبْلَ الدَّفْنِ فَيُعَزَّى وَيَدْعُوْا لَهُ.
ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম ছওরী (রা:) বলেন যে দাফনের পরে নয় দাফনের আগে সমবেদনা জ্ঞাপন করা সুন্নত। কেননা দাফনের আগে বিরহ বেদনাটা বেশি থাকে, সুতরাং (দাফনের আগে) শোক প্রকাশ করবেন এবং মইয়তের জন্য দুআ প্রার্থনা করা হয়।
উপরোক্ত ভাষ্য থেকে প্রমানিত হয় যে দাফনের আগে, নামাযের আগে বা পড়ে হোক, শোক প্রকাশ করা জায়েয এবং সুন্নাত । আর সমবেদনায় মৃতব্যক্তি ও তার উত্তরাধিকারীর জন্য যথাক্রমে ছওয়াব ও ধৈর্যের জন্যইতো দুআ করা হয়। বিবেকও বলে যে নামাযে জানাযার পর দুআ জায়েয। কেননা নামাযে জানাযা এক হিসেবে দুআ বিশেষ, কারন এতে মৃতব্যক্তিকে সামনে রাখা হয় এবং এতে রুকু সিজদা তাশাহুদ ইত্যদি নেই। আবার আর এক হিসাবে নামাযও বলা যায় । কারন এর জন্য গোসল, ওযু সতর ডাকা কিবলামুখি হওয়া জায়গা ও কাপড় পাক করা বাঞ্ছনীয় এবং জামাত সহকারে পড়া সুন্নাত। যদি এটা কেবল দুআই হতো, তাহলে নামাযের মত এসব শর্তসমুহ কেন আরোপ হলো ? অন্যান্য দুআর মত যে কোন প্রকারে আদায় করলেয় হয়ে যেত। তাই স্বীকার করতেই হবে যে এটা এক হিসাবে নামাযও এবং প্রত্যেক নামাযের পর দুআ প্রার্থনা করা সুন্নাত ও কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশী । যেমন মিসকাত শরীফে- اَلذِّكْرُ بَعْدُ الصَّلَوةِ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে-
قِيْلَ يَارَ سُوْلَ اللهِ اَىُّ الدُّعَاءِ اَسْمَعُ قَالَ جَوْقَ اللَّيْلِ الْاَخِرِ وَدَبْرَ الصَّلواة الْمَكْتُوْبَاتِ
হুযুর আলাইহিস সালামের সমীপে আরজ করা হয়েছিল কোন দু’আটি বেশি কবুল হয়। তিনি এরশাদ ফরমান শেষ রাত্রির মধ্যবর্তী সময় ও ফরজ নামাজ সমুহের পরে জানাযার নামাজও ফরজ । তাই এর পর দু’আ কেন করা যাবে না ? অধিকন্তু যে কোন সময় দুআ প্রার্থনা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং। অনেক গুরুত্বরোপ করা হয়েছে। মিসকাত শরীফের কিতাবুদ দাওয়াতে বর্ণিত আছে الدُّعاءُ هُوَالْعِبَادَةُ দুআ এক প্রকার এবাদত একই জায়গায় এটাও উল্লেখ আছে الدُّعَاءُ مُخّ الْعِبَادَةِ দুআ ইবাদতের মুল। দুয়া প্রার্থনা করার জন্য সময় কালের কোন বিধি নিষেধ নেয়। তাহলে এটার কি কারন থাকতে পারে যে জানাযার আগে ও দাফনের পরে দুআ করা জায়েয। কিন্তু নামাজের পড়ে ও সাথে দুআ ও ইছালে ছওয়াব হারাম হয়ে গেল এবং পর ওই যাদু অপসারিত হলো ও সব কিছু হালাল হয়ে গেল । যে কোন সময় দুআ প্রার্থনা ও ইছালে ছওয়াব জায়েয, এর জন্য কোন সময়ের বিধি নিষেধ নেয় । -সূত্রঃ জা’আল হক ২য় খন্ড-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thaks for watching www.sunnihaque.blogspot.com